গণমাধ্যমকর্মীদের চাকরিচ্যুত করার ষড়যন্ত্র, এসএটিভি থেকে হেড অব নিউজ ফয়সালকে বের করে দিলো বিক্ষুব্ধরা
আজকের সংবাদ ডেস্কঃ: শতাধিক গণমাধ্যমকর্মীকে চাকরিচ্যুত করার চক্রান্তসহ প্রথম ধাপে ১০ জনকে ছাঁটায়ের জের ধরে হেড অব নিউজ মাহমুদ আল ফয়সালকে এসএ টেলিভিশন কার্যালয় থেকে বের করে দেয়া হয়েছে। বুধবার রাত পোনে ১০টার দিকে টেলিভিশনটির সবগুলো বিভাগের বিক্ষুব্ধ কর্মীরা তাকে এসএটিভি কার্যালয় ছেড়ে যেতে বাধ্য করেন। এসময় তারা হেড অব নিউজ ফয়সালের কয়েকজন সহযোগির বিরুদ্ধে শ্লোগান দেন।
সে সময় এসএটিভির ব্যবস্থাপনা পরিচালক সালাহউদ্দিন আহমেদ বিক্ষুব্ধ গণমাধ্যমকর্মীদের সঙ্গে কথা বলেন। তবে তিনি বিষয়টির তাৎক্ষণিক সমাধান না করে বৃহস্পতিবার(২৮নভেম্বর) সাংবাদিক নেতাদের সঙ্গে কথা বলার আগ্রহ প্রকাশ করেন। অবশ্য ক’দিন আগ থেকেই প্রতিষ্ঠানটির কর্মীরা ব্যবস্থাপনা পরিচালকের সঙ্গে বৈঠকের দাবি জানিয়ে আসছিলেন। কিন্তু তিনি তাদের সময় দেননি। এরইমধ্যে বুধবার সন্ধ্যায় সালাহউদ্দিন আহমেদ তার গুলশানের বাসভবনে সিওও খ ম হারুন, হেড অব নিউজ মাহমুদ আল ফয়সাল এবং ভারপ্রাপ্ত হেড অব প্রোগ্রাম আশরাফ-উজ-জামান এবং প্রোডিউসার কামরুজ্জামান (রঞ্জু)সহ কয়েকজনকে নিয়ে রুদ্ধদার বৈঠকে বসেন। সেখানে মাহমুদ আল ফয়সালের পরামর্শ অনুযায়ী নিউজ কমানো এবং দিনব্যাপী সিনেমা চালানোসহ বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা হয়।
এরআগে প্রতিষ্ঠানটির ১৩০ জনকে চাকরিচ্যুত করার পরিকল্পনা গ্রহণসহ তালিকা তৈরি করে ব্যবস্থাপনা পরিচালককে দেন হেড অব নিউজ। এরই ধারাবাহিকতায় এফপিসি পরিবর্তন এবং কর্মী ছাঁটাই পর্ব শুরু হয়েছে। প্রথম দফায় প্রোগ্রামের ১০ জনকে ছাঁটাই করা হয়েছে। প্রোগ্রাম হেড জিনাত জেরিন আলতাফকে বাধ্যতামূলক ছুটি দেয়া হয়েছে। কর্মীদের দাবি, সব পরিকল্পনার মূলেই হেড অব নিউজ। তিনি বার্তাকক্ষের ৪-৫ জনকে সঙ্গে নিয়ে ছাঁটাই-চক্রান্ত এবং হয়রানি শুরু করায় তারা বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছেন। সেইসঙ্গে কয়েকদিন ধরে ব্যবস্থাপনা পরিচালকের সঙ্গে তারা বৈঠকের দাবি জানিয়ে আসছিলেন। কিন্তু তিনি সময় দিয়েও পরে তা বাতিল করেন। এরপর উত্তেজনা আরো বাড়তে থাকে। এরইমাঝে হেড অব নিউজের সব চক্রান্ত প্রকাশ পাওয়াসহ এমডির গুলশানের বাসভবনে রুদ্ধদার বৈঠকের খবরে পরিস্থিতি আরো ঘোলাটে হয়ে ওঠে। সারাদিন অপেক্ষার পরও এমডির সাক্ষাত না পাওয়া গণমাধ্যমকর্মীরা অপেক্ষা করতে থাকেন। এক পর্যায়ে রাত পৌনে ১০টার দিকে এমডি এবং হেড অব নিউজ এসএটিভি কার্যালয়ে আসেন। এরপর বিক্ষুব্ধ কর্মীরা হেড অব নিউজের সঙ্গে কথা বলতে আসেন। তখনই উত্তপ্ত বাক্য বিনিময়ের এক পর্যায়ে সব চক্রান্ত এবং চাকরিচ্যুত করার মূলেই তিনি বলে দায়ি করেন কর্মীরা। হেড অব নিউজকে এসএটিভিতে আর দেখতে চান না বলে সাফ জানিয়ে দেন। তখনই তাকে বের হয়ে যেতে বলেন তারা। কিন্তু তিনি সময় চেয়ে কালক্ষেপনের চেষ্টা করলে সবাই ধরে নিউজরুম থেকে নিয়ে গেটের বাইরে দিয়ে আসেন। এসময় সেখানে আসেন গুলশান থানার পুলিশ সদস্যরাও। তারা এসে গণমাধ্যমকর্মী এবং এমডির সঙ্গে কথা বলেন। গণমাধ্যমকর্মীরা দাবি-দাওয়া আদায়ে সাংবাদিক ইউনিয়ন নেতাদের সঙ্গে সাক্ষরিত চুক্তিভঙ্গের বিষয়টি তুলে ধরা ছাড়াও হেড অব নিউজের অনৈতিক কর্মকান্ড তুলে ধরেন। সেখানে বক্তব্য রাখেন এমডি সালাহউদ্দিন আহমেদ। সাংবাদিক নেতাদের সঙ্গে বৈঠকের পর উদ্ভুত পরিস্থিতির সমাধান করবেন বলেও ইঙ্গিত দেন।
এসএটিভিতে উদ্ভুত পরিস্থিতি যেভাবে শুরু বেশকয়েক মাসের বেতন বকেয়া। এরপরও কাজ করছিলেন এসএটিভির কর্মীরা। এরইমাঝে চলতি মাসের আগস্টে হেড অব নিউজ মাহমুদ আল ফয়সাল যোগদানের পর নানা চক্রান্ত শুরু করায় নিউজরুমের পরিস্থিতি খারাপ হতে থাকে। এরআগে ফয়সাল দুর্নীতি আর নানা অপকর্ম করায় ২০১৭ সালের ৩ আগস্ট এসএটিভি থেকে বিতাড়িত হয়েছিলেন। সেই সময় যারা বিভিন্নভাবে তথ্য-প্রমাণ দিয়ে তদন্ত কমিটিকে সহযোগিতা করেছিল। তাদের এসএটিভি থেকে সরিয়ে দিতে টার্গেট করেন তিনি। এরইমধ্যে ১৪ সেপ্টেম্বর শনিবার সন্ধ্যা ৭টার নিউজে ইন্টারন্যাশনাল ডেস্কের একটি প্যাকেজ নিউজে একজন ক্লিনারকে দিয়ে ভয়েজ দেয়ার নির্দেশ দেন হেড অব নিউজ। এই ঘটনা নিয়ে রিপোর্টাররা বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠেন। নিউজরুমে রিপোর্টার মাহমুদুল হাসান, আরিফ হোসাইন এবং মাহমুদুল হকসহ কয়েকজন ভিডিও এডিটর ঘটনাটিকে ন্যাক্কারজনক এবং হেড অব নিউজকে নোংরা এবং খারাপ লোক বলে মন্তব্য করে। এরপর হেড অব নিউজের বিরুদ্ধে ক্লিনারের সঙ্গে সখ্যতার কাহিনী মিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়লে তিনি সেই ঘটনা আড়াল করতে অফিসে না আসাসহ অসহযোগিতার অভিযোগ এনে হাসান, আরিফ, মাহমুদ, সাদেক, সাকি, মোহসীন এবং মিলনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার সিদ্ধান্ত নেন। এদের মধ্যে মিলন এবং সাকি হেড অব নিউজকে ভরা মিটিংয়ে তিরস্কার করেছিল। তাদের জুনিয়র ফারজানা শোভাকে সিনিয়র রিপোর্টার হিসেবে যোগদান করানোর দায়ে। হেড অব নিউজ নারায়ণগঞ্জ থেকে নিউজ করা বাবদ ৩৫ হাজার টাকা নিয়েছিলেন, সেই ঘটনা সাদেক অফিসকে জানিয়েছিল। মোহসিন অফিসকে এসএমএস দিয়েছিল তার মা অসুস্থ অফিসে আসতে পারবে না। এরপরও হেড অব নিউজ পুরনো প্রতিশোধ নিতে ব্যবস্থা নেয়ার পরিকল্পনা নেন। শেষ পর্যন্ত তাদের চাকরিচ্যুত করা হলেও সাংবাদিক ইউনিয়নের কর্মসূচির কারণে আটকে যায়। এরপর নিউজরুমসহ অন্য বিভাগেরও ১৩০ জনকে চাকরিচ্যুত করার নতুন কৌশল নেন হেড অব নিউজ মাহমুদ আল ফয়সাল। এরমধ্যে প্রোগ্রামের ক্যামেরাপার্সন ও প্রোডিউসারসহ ১০ জনকে চাকরিচ্যুত করা হয়েছে। অন্যদিকে, গত ২২ নভেম্বর কোলকাতা টেস্ট উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে যোগ দিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সেই সংবাদটির জন্য অফিসের অনুমতি নিয়ে সেখানে যান স্পোর্টস ডেস্কের আরিফ হোসাইন। আর অফিস থেকে স্ক্রিপ্ট লিখে ভয়েজ দেন নুরউদ্দিন। প্যানেলে নিউজটির তত্ত্বাবধান করেন মাহমুদুল হাসান। এই নিউজের জন্য এই তিনজনকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেয়া হয়েছে। এটিও তাদের চাকরিচ্যুত করার পরিকল্পনার অংশ হিসেবেই বলে ধরে নেন তারা। এসব ঘটনা নিয়েই এসএটিভির সব কর্মীরা বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন। এক পর্যায়ে হেড অব নিউজ মাহমুদ আল ফয়সালকে অফিস থেকে বের করে দেয়ার পাশাপাশি অবাঞ্চিত ঘোষণা করা হয়েছে। বাংলাদেশের মিডিয়া থেকেই তাকে অবাঞ্চিত ঘোষণার দাবি তুলেছে এসএটিভির কর্মীরা।
দু’বছর আগেও এসএটিভিতে যোগদান করেছিলেন মাহমুদ আল ফয়সাল। সেসময় তার বিরুদ্ধে গাজীপুর থেকে ৩০ লাখ টাকা চাঁদাবাজিসহ নানা অনৈতিক কর্মকান্ডের অভিযোগ ওঠে। চ্যানেলটির সংবাদকর্মীরা এমডির সামনে মাহমুদ আল ফয়সালের অনিয়ম-দুর্নীতির বিস্তারিত বিবরণ তুলে ধরেন তার উপস্থিতিতেই। তিনি অভিযোগের জবাব দিতে ব্যর্থ হলে কর্তৃপক্ষ তাকে সাময়িক অব্যাহতি দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। এছাড়া চূড়ান্ত তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের জন্য গঠিত কমিটিকে তাগিদ দেয়া হয়। সেই কমিটির তদন্তে তার দুর্নীতি প্রমাণিত হওয়ায় তাকে ২০১৭ সালের ৩ আগস্ট বৃহস্পতিবার রাতে অব্যাহতি দেয় এসএটিভি কর্তৃপক্ষ। এরপর ওই রাতেই নিজের প্রয়োজনীয় নথিপত্র নিয়ে অফিস ত্যাগ করেন মাহমুদ আল ফয়সাল। চ্যানেলটিতে যোগদানের এক বছর পূর্ণ হওয়ার আগেই সেবার তিনি চাকরিচ্যুত হয়েছিলেন। পরে হেড অব নিউজে কক্ষ তল্লাশি করে চার বোতল বিদেশী মদ উদ্ধার করা হয়।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন